পুলিশের লাঠিচার্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা আহত হওয়ার ঘটনায় পটিয়ায় চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক ৭ঘণ্টা অবরোধ করে ছাত্ররা। এসময় অবরোধকারী ছাত্ররা পটিয়া থানার ওসি আবু জায়েদ মো. নাজমুন নূরের স্থায়ী অপসারণ ও শাস্তি দাবি করেন। গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ৯টায় পটিয়া থানার সামনে ছাত্ররা থানা ঘেরাও এবং সড়ক অবরোধ করেন। সকাল সাড়ে ১১টায় অবরোধকারীরা মিছিল নিয়ে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের মডেল মসজিদ এলাকায় গিয়ে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে রাখে। এসময় সড়কের দুইপ্রান্তে দীর্ঘ ১০কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয় এবং অফিস আদালতগামী যাত্রীরা চরম দুর্ভোগের শিকার হয়।
সন্ধ্যা ৬টায় অবরোধ চলাকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রামের সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি মহাসড়কে এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেন, পটিয়া থানার ওসিকে সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে স্থায়ীভাবে অপসারণ করা না হয়, তাহলে বৃহস্পতিবার (আজ) সারা চট্টগ্রাম সকাল ১০টা থেকে ব্লকেড কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের প্রতিবাদের মুখে পটিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু জায়েদ মো. নাজমুন নূরকে গতকাল বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) সাইফুল ইসলাম রাতে গণমাধ্যমকে বলেন, পটিয়ার ওসিকে প্রত্যাহার করে চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে।
অপরদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের হাতে আটক রাঙামাটি জেলা ছাত্রলীগের সহ সভাপতি দীপঙ্কর দেকে পুলিশ গ্রেপ্তার না করার জেরে পটিয়ায় পুলিশের সাথে বাকবিতন্ডা ও ধস্তাধস্তির ঘটনায় পুলিশের পুলিশের লাঠিচার্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৭ সদস্যসহ ১৫ জন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে ছাত্র সমন্বয়করা তাদের ২০ জন সদস্য আহত হয়েছে বলে দাবি করেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ওসির অপসারণের দাবিতে থানা ঘেরাও, বিক্ষোভ সমাবেশ, প্রতিবাদ মিছিল ও চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধ করেছে। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে অবরোধ শুরু হওয়ার পর বিকাল ৩টায় একদল সেনাসদস্য নিয়ে মেজর তাসমিন নূর, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফারহানুর রহমান, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্লাবন কুমার বিশ্বাস অবরোধ স্থলে উপস্থিত হয়। অবরোধ তুলে নেওয়ার জন্য সমন্বয়কদের সাথে সমঝোতার চেষ্টা করলেও দাবি আদায় না হওয়ায় সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ছাত্ররা মহাসড়কে অবরোধ করে রাখে। অবরোধের ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রামে এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর কর্মসূচি বাতিল হয়ে যায়। এসময় সড়ক অবরোধ ও আন্দোলনে যোগ দেন দক্ষিণাঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক জুবায়রুল হাসান আরিফ, চট্টগ্রাম মহানগর মুখ্য সংগঠক তৌসিফ ইমরোজ, মহানগর সংগঠক মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, মহানগর সদস্য নিজাম উদ্দিন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রামের সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার আহবায়ক জুবায়ের হোসেন। দক্ষিণ জেলার সচিব মোহাম্মদ সাঈদ, উত্তর জেলার আহবায়ক মো. আরেফিনসহ কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতৃবৃন্দ।
চট্টগ্রাম মহানগর সংগঠক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, পটিয়া থানা ওসি, এডিশনাল এসপি আরিফুল ইসলামকে চাকরি থকে অব্যাহতি দিতে হবে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দেলন চালিয়ে যাব। গণ অধিকার পরিষদ চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার আহ্বায়ক ডা. এমদাদুল হাসান, কেন্দ্রীয় উচ্চতর পরিষদ সদস্য জসিম উদ্দিন আকাশ আন্দোলনে যোগ দেন। ডা. এমদাদ দাবি করেন–গতকাল যে লাঠিচার্জ করা হয়েছে তাদের চাকরি থেকে বরখস্ত করতে হবে।
জানা যায়, গত মঙ্গলবার রাত ৯টায় ১ লা জুলাই উপলক্ষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা পটিয়া পৌরসভার শহীদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্বলন কর্মসূচি শেষে ওয়াপদা রোডের সামনে থেকে দীপংকর তালুকদার নামের রাঙামাটি জেলা ছাত্রলীগের এক নেতাকে আটক করে পটিয়া থানায় সোপর্দ করে। তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা না থাকায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে অসম্মতি জানায়। এতে ছাত্ররা থানার ভেতর ওসির কক্ষের সামনে ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে থাকে। এ অবস্থায় ওসি আবু জায়েদ মোহাম্মদ নাজমুন নূরের নির্দেশে একদল পুলিশ ছাত্রদের থানা কম্পাউন্ড থেকে বের করে দিতে চাইলে পুলিশের সাথে ছাত্রদের মধ্যে বাকবিতন্ডা শুরু হয়। এসময় পুলিশের লাঠিচার্জে পটিয়ার বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতা তৌকিরসহ ১০জন আহত হয়। পরে ছাত্ররা ক্ষুব্ধ হয়ে থানার সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। রাত সাড়ে ১২টার দিকে জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামানসহ ডিবি ও রিজার্ভ পুলিশের একটি টিম থানার প্রধান ফটকে আসে। এসময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রাম মহানগরের যুগ্ম আহ্বায়ক রিদওয়ান সিদ্দিকীসহ ২০–৩০ জন আন্দোলনকারী পুলিশের মুখোমুখি হয়। পরে পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ করলে দ্বিতীয় দফায় ১১জন ছাত্র আহত হয়। আহতদের মধ্যে রয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রাম মহানগরের যুগ্ম আহ্বায়ক রিদওয়ান সিদ্দিকী, পটিয়ার সংগঠক আশরাফুল ইসলাম তৌকির (২১), মো. নাদিম (২১), মো. আয়াস (১৬), মো. আকিল (১৮), মো. ইরফান উদ্দিন (১৮), তাসরিয়ান হাসান (১৮), মো. রায়হান উদ্দিন (২০), সাইফুল ইসলাম (১৭), জাহেদুল করিম শাহী (১৮), মুনতাসির আহমদ (১৭) ও সাইফুল ইসলাম (১৮)।
পুলিশি হামলার খবর পেয়ে ছাত্র সমন্বয়ক ১০/১৫ জন সদস্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আহত ছাত্রদের পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। রাতের মধ্যেই সমন্বয়করা চট্টগ্রাম জেলা সমন্বয়কসহ বিভিন্ন স্থানে বিষয়টি জানালে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে সুসংগঠিত হয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকার্মীরা গতকাল বুধবার সকাল থেকে পটিয়া সদরে হাজির হয়। সকাল ৯টায় ছাত্ররা থানার সামনে অবস্থান করে থানা ঘেরাও করে রাখে। রাতে পুলিশ থানার মূল ফটক বন্ধ করে দেওয়ায় আন্দোলনকারীরা থানার ভিতরে প্রবেশ করতে পারেনি। এসময় ছাত্ররা ওসি জায়েদ নূরের অপসারণসহ তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রামের সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি ও মহানগর মুখপাত্র ফাতেমা খানম তাদের বক্তব্যে বলেন, ওসি আবু জায়েদ মোহাম্মদ নাজমুন নূর ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুল ইসলাম আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের দোসর। পটিয়া থানায় ৫ আগস্টের পর ছাত্রদের উপর হামলার ঘটনা নিয়ে যে মামলা হয়েছে সে মামলার একজন প্রকৃত আসামিও তারা গ্রেপ্তার করেনি। পটিয়া থানার ওসিসহ অধিকাংশ এস আই আওয়ামী দোসর হওয়ায় তারা আওয়ামীলীগের লোকজনকে নিরাপত্তা দিচ্ছে। দুপুর ১২টায় আন্দোলনকারী ছাত্ররা মিছিল নিয়ে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের ইন্দ্রপোল বাইপাস এলাকায় মডেল মসজিদের সামনে অবস্থান নেয়। তারা মহাসড়কে টায়ার জ্বালিয়ে মহাসড়ক অবরোধ করে। এতে মহাসড়কের দুই দিকে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে যায়। দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল করতে পারেনি। যাত্রীরা অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হয়।
এ ব্যাপারে পটিয়া উপজেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা তালহা রহমান জানান, পুলিশ রাত্রে তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে এবং ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়েছে। ওসির নির্দেশে এঘটনা ঘটানো হয়েছে। ওসিকে প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত তারা সড়ক অবরোধসহ আন্দোলন চালিয়ে যাবে। এ বিষয়ে পটিয়া থানার ওসি আবু জায়েদ মো. নাজমুন নূর বলেন, ছাত্র সমন্বয়কেরা থানা কম্পাউন্ডে মব সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন। তাদের বাধা দিলে তারা পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে ৩/৪ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম সানতু বলেন, তারা থানার সামনে অবস্থান নিয়ে কিছু দাবির কথা জানিয়েছে। আমরা সেটি বিবেচনা করছি। আশা করি দ্রুত শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে।
মহাসড়ক অবরোধে ভোগান্তি : পটিয়া উপজেলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা–কর্মীদের মহাসড়ক অবরোধের কারণে দুর্ভোগে পড়েছে হাজারো মানুষ। বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পটিয়া বাইপাস এলাকায় চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধ করেন তারা। এর আগে সকাল ১০টা ৪০ মিনিট থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত পটিয়া থানার সামনে মহাসড়ক অবরোধ করা হয়। পরে আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে মহাসড়কের পটিয়া সদরের মডেল মসজিদ সংলগ্ন কাগজীপাড়া এলাকায় রাস্তায় অস্থান নেয়। তারা রাস্তায় অবস্থান নিয়ে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত মহাসড়ক অবরোধ করে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। এসময় মহাসড়কের উভয় প্রান্তে প্রায় ১০ কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে দূরপাল্লার যাত্রীরা। তবে পরীক্ষার্থী ও অ্যাম্বুলেন্স চলাচল করতে দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্যকে এ সময় দেখা যায়নি। ‘চট্টগ্রামের সর্বস্তরের ছাত্র–জনতার’ ব্যানারে এই অবরোধ ডাক দেয়া হয়। পটিয়া মডেল মসজিদ সংলগ্ন মহাসড়কে আন্দোলনকারীরা সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। এসময় যান চলাচল করতে না পারায় অনেকেই হেঁটে গন্তব্যে যান।